খুন, গুম-জুলুমে বিক্ষুব্ধ ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত বাংলাদেশ। স্বৈরাচারের নাগপাশে ঝলসে গেছে শত শত প্রতিবাদের মুখ। হাজার হাজার মানুষ বন্দি কারাগারে। বাড়ছে গোপন বন্দিশালা আয়নাঘর। দুর্নীতি, লুটপাট যেন মহোৎসব। একে একে ধসে পড়ছে ব্যাংক। তবু চারদিকে বাড়ছে ফ্যাসিস্টবন্দনা। সাধুবেশে শয়তানরা দিচ্ছে হাঁক। মরে মরুক সব, জঙ্গি-সন্ত্রাস। ‘আপা’ আপনি থাকছেন। আপনিই সব।
দিনের ভোট হয়ে যাচ্ছে রাতে। আমি-ডামি ভোটেও বিপর্যস্ত বাংলাদেশ। ভোট থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় জনতা। ভোট কেড়ে নেওয়ার এই নগ্ন খেলায় একটি প্রজন্মই ছিটকে পড়ে ভোটের মাঠ থেকে।
এভাবে দিন গড়িয়ে মাস যায়, বছর ঘুরে বছর আসে। শেষ হয় না শাসকের শোষণ। ক্ষোভ-বিক্ষোভ, বুকফাটা আর্তনাদ, কান্নার ষোলো বছর ছুঁইছুঁই। মুক্তিকামী মানুষের আহাজারি আকাশে-বাতাসে। ঠিক তখন যেন ঝাঁকে ঝাঁকে নেমে আসে অপ্রতিরোধ্য আবাবিল। জুলাই পদধ্বনির প্রহরে ততক্ষণে উত্তাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শাহবাগ। এবার বিপ্লবীরা জীবন দেবে। তাই টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া জেগে উঠল অন্য এক বাংলাদেশ।
বিপ্লবীদের আত্মত্যাগে ফররুখ আহমেদের পাঞ্জেরি কবিতার ‘গভীর রাত’ ছুটছে ভোরের দিকে। রক্তাক্ত জুলাইয়ে দাঁড়িয়ে একে একে বীররা নিজের নাম সগৌরবে লিখে যাচ্ছে নতুন ইতিহাসের পাতায়। দেশের জন্য জীবনজয়ী লাশ হাসিমুখে ছুটছে মর্গে। ‘রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি? এখনো তোমার আসমান ভরা মেঘে? সেতারা হেলাল এখনো ওঠেনি জেগে?’
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়-‘আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে ভয়াল কালবৈশাখীর উন্মাতাল গতির প্রতাপ বক্ষে ধারণ করে-দিক থেকে দিগন্তে স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে লক্ষকোটি বজ্রের গর্জন;
বলরে বন্য হিংস্র বীর,
দুঃশাসনের চাই রুধির!
ঘোষো দিকে দিকে এই কথাই,
দুঃশাসনের রক্ত চাই!’
এদিকে কবির এই অগ্নিগর্ভ উচ্চারণ বুকে ধারণ করে, মাতৃমুক্তির ইস্পাতদৃঢ় শপথে দৃপ্ত দেশপ্রেমিক দামাল ছেলেরা ছিনিয়ে আনে বিজয়। শেষ পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদী শক্তির কাছে টিকে থাকতে পারেনি ফ্যাসিস্ট। ছত্রিশে জুলাইয়ের প্রত্যুষে শত সহস্র শহীদের রক্তের হাসিমুখ নিয়ে পূর্বদিগন্ত আকাশজুড়ে জেগে ওঠে রক্ত লাল প্রত্যয়ে প্রদীপ্ত সূর্য। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে তেজোতীপ্ত খুন রাঙা বিপ্লবের তেজ।
অতঃপর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ৫ আগস্ট ২০২৪। ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থান। ভরদুপুরে লাখ লাখ মানুষের জোয়ার যখন গণভবনের পথে গণবিস্ফোরণ ঘটাতে প্রস্তুত। ঠিক তখন জনরোষ থেকে বাঁচতে স্বৈরাচারও সদলবলে দেশ ছাড়তে হন্তদন্ত। বিদায় শেখ হাসিনা। বিদায় আওয়ামী লীগ সরকার। ভারতের উদ্দেশে হেলিকপ্টারযোগে পালিয়ে যান সাবেক এ প্রধানমন্ত্রী।
এভাবে সেদিন ইতিহাসের পাতায় নতুন একটি অবিশ্বাস্য ও শ্বাসরুদ্ধকর ইতিহাস লেখা হয়ে যায়। রক্তের অক্ষরে লেখা হয় ‘জুলাই বিপ্লব’-২০২৪। রক্তাক্ত সেই জুলাই জাগরণ যাত্রার বছরপূর্তির দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ। চারদিকে বিপ্লবীদের লাল সালাম। হিসাব হবে, হিসাব নেবে এই জনতা। কী চেয়েছিলাম, কী পেলাম আমরা। তবু শপথ নেওয়ার দিন আজ। শহীদদের রক্ত ছুঁয়ে এগিয়ে যাক সবাই, এগিয়ে যাক আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ।
যেভাবে সূত্রপাত এই গণ-অভ্যুত্থানের: সরকারি দপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন করপোরেশনের চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে (৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড) মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে ৫ জুন রায় প্রদান করা হয়।
এ রায়ের মাধ্যমে জুলাই-আগস্টের ছাত্র আন্দোলনের সূচনা হয়। এ রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে পরের দিন ৬ জুন সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা (মুক্তিযোদ্ধা কোটা) পুনর্বহালে আদালতের দেওয়া রায় বাতিলের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বিক্ষোভ হয়। ‘সরকারি চাকরিতে ২০১৮ সালের পরিপত্র বাতিল করে কোটা পদ্ধতি পুনর্বহালসংক্রান্ত হাইকোর্টের রায়ের প্রতিবাদ জানিয়ে এবং চাকরিতে মেধাভিত্তিক নিয়োগ বহাল রাখার দাবিতে’ এ বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করা হয়।
‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীবৃন্দ’-এর ব্যানারে আয়োজিত এ কর্মসূচিতে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী অংশ নেন। এরপর ৯ জুন সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা পুনর্বহালের প্রতিবাদে আবারও বিক্ষোভ সমাবেশ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি মানতে সরকারকে ৩০ জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দেন। এ সময়ের মধ্যে দাবি পূরণ না হলে সর্বাত্মক আন্দোলনের ঘোষণা দেন তারা। একই দাবিতে চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও আন্দোলন কর্মসূচি পালন করেন।
রক্তাক্ত জুলাই যাত্রা: এরপর ১ থেকে ৪ জুলাই ঢাকাসহ সারা দেশে ছাত্র সমাবেশ ও বিক্ষোভ চলতে থাকে। বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা ৪ জুলাই ঢাকায় শাহবাগ মোড় অবরোধ করে রাখেন ৫ ঘণ্টা। এদিন ছাত্র সমাবেশ থেকে ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়।
৬ জুলাই দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আগের দিনের মতোই বিক্ষোভ ও অবরোধ কর্মসূচি পালন করা হয়। এ সময় আন্দোলনকারীরা সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন, ছাত্র ধর্মঘট এবং সারা দেশে সড়ক-মহাসড়ক অবরোধের ডাক দেন। এর নাম দেওয়া হয় ‘বাংলা ব্লকেড’। ৭ জুলাই রোববার শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফ‚র্ত অংশগ্রহণে ‘বাংলা ব্লকেডে’ স্থবির হয়ে পড়ে পুরো রাজধানী। এদিন অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা করা হয়।
৮ জুলাই কোটাবৈষম্যের বিরুদ্ধে এবং স্থায়ী সমাধানের দাবিতে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামে ৬৫ সদস্যের সমন্বয়ক টিম গঠন করা হয়। ১০ জুলাই সরকারি চাকরিতে সরাসরি নিয়োগে (৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড) কোটার বিষয়ে পক্ষগুলোকে চার সপ্তাহের জন্য স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে নির্দেশ দেন আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের আপিল বিভাগ এ আদেশ দেন। শুনানির জন্য ৭ আগস্ট দিন রাখা হয়।
১১ জুলাই বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা সর্বোচ্চ আদালতের বিরুদ্ধে শক্তি প্রদর্শন করছেন। এটি অনভিপ্রেত ও সম্পূর্ণ বেআইনি। ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন ওবায়দুল কাদের। সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, শিক্ষার্থীরা ‘লিমিট ক্রস’ করে যাচ্ছেন। এদিন পুলিশের বাধার মুখেই দেশের বিভিন্ন স্থানে অবরোধ পালন করেন আন্দোলনকারীরা। ১২ ও ১৩ জুলাই শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলতে থাকে।
শেখ হাসিনার যে বক্তব্যে বিস্ফোরণ ঘটে: ১৪ জুলাই গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বললেন, ‘কোটা বিষয়ে আমার কিছু করার নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘মামলার পর আদালত যে রায় দেন, এতে নির্বাহী বিভাগের কিছু করার নেই। আদালতেই সমাধান করতে হবে।’ একজন সাংবাদিকের আরেক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিপুতিরা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা চাকরি পাবে?’
একইদিনে পদযাত্রা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দিয়ে আন্দোলনকারীরা জাতীয় সংসদে জরুরি অধিবেশন ডেকে সরকারি চাকরির সব গ্রেডের কোটার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে সরকারকে ২৪ ঘণ্টার সময় বেঁধে দেন।
পরে মধ্যরাতে সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের অবমাননা করা হয়েছে দাবি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। রাত ১০টা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আবাসিক হলে বিক্ষোভের পর মধ্যরাতে শিক্ষার্থীরা জড়ো হন টিএসসির রাজু ভাস্কর্যে। ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’সহ নানা ধরনের স্লোগান দেন জমায়েত শিক্ষার্থীরা।
ওবায়দুল কাদেরের সেই ‘উসকানি’: ১৫ জুলাই বেলা ২টায় রাজধানীর ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকার’ স্লোগানের জবাব ছাত্রলীগই দেবে বলে মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
তিনি বলেন, আন্দোলন থেকে আÍস্বীকৃত রাজাকার ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ মানসিকতা বা আচরণের প্রকাশ ঘটেছে। এর জবাব দেওয়ার জন্য ছাত্রলীগ প্রস্তুত। এরপর দুপুরে কোটা সংস্কার আন্দোলনে যারা ‘আমি রাজাকার’ স্লোগান দিচ্ছেন, তাদের শেষ দেখিয়ে ছাড়বেন বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন। বেলা ৩টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দফায় দফায় ছাত্রলীগ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এ সময় আন্দোলনকারী নারী ও পুরুষ শিক্ষার্থীদের মারধর করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তা ও ফুটপাত শিক্ষার্থীদের রক্তে লাল হয়ে পুরো ক্যাম্পাস এলাকা রূপ নেয় যুদ্ধক্ষেত্রে। এ সময় গুলি করতেও দেখা যায়।
দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলা অব্যাহত। আহতদের নেওয়া হচ্ছে হাসপাতালে। ২৯৭ জন ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নেন। হামলার প্রতিবাদে আন্দোলনকারী ও ছাত্রলীগ উভয়ই সমাবেশ করার ঘোষণা দেয়। পরের দিন সারা দেশে দিনভর ব্যাপক বিক্ষোভ ও সংঘর্ষ হয়। আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করে ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ সরকার সমর্থকরা। এতে নিহত হন ছয়জন।
আবু সাঈদের মৃত্যু-আগুন লাগে আন্দোলনে
১৬ জুলাই। রংপুরে আন্দোলনকারী বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ পুলিশের বুলেটে নিহত হওয়ার সচিত্র ছবি প্রকাশ পায়। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে বুধবার গায়েবানা জানাজা ও কফিন মিছিল করার ঘোষণা দেন। ১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিতাড়িত করে ‘রাজনীতিমুক্ত’ ঘোষণা করা হয়।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের একপর্যায়ে ১৭ জুলাই রাত থেকে মোবাইল ইন্টারনেট এবং ১৮ জুলাই রাতে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যায়। পাঁচ দিন পর ২৩ জুলাই ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ সীমিত পরিসরে ফেরে। ১০ দিন পর ২৮ জুলাই মোবাইল ইন্টারনেট চালু হয়। কিন্তু বন্ধ ছিল মেটা প্ল্যাটফরম ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ ও ইনস্টাগ্রাম। এছাড়া টিকটকও বন্ধ রাখা হয়।
বাড়তে থাকে বিপ্লবীদের মৃত্যু
১৮ জুলাই দেশব্যাপী প্রতিরোধ, সহিংসতা, সংঘর্ষ ও গুলির ঘটনায় উত্তাল। মোট নিহত হন ২৭ জন। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ঢাকাসহ সারা দেশ ছিল প্রায় অচল।
রাজধানী ছাড়াও দেশের ৪৭টি জেলায় দিনভর বিক্ষোভ, অবরোধ, পালটাপালটি ধাওয়া, পুলিশের হামলা-গুলি ও সংঘাতের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত দেড় হাজার। কোথাও কোথাও আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের, আবার কোথাও সরকার সমর্থক বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ হয়।
‘শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে পুলিশ, বিজিবি, র্যাব ও সোয়াতের ন্যক্কারজনক হামলা, খুনের প্রতিবাদ, খুনিদের বিচার, সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাস নিশ্চিত করা এবং কোটাব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে’ দলে দলে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে এলে সংঘর্ষের এসব ঘটনা ঘটে। সারা দেশে বিজিবি মোতায়েন করা হয়।
১৯ জুলাই সরকারের সঙ্গে সংলাপের প্রস্তাব ফের প্রত্যাখ্যান করেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। তারা উলটো ৯ দফা দাবি পেশ করেন। যার প্রথম দফায় ছিল- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ছাত্র হত্যার দায় নিয়ে জাতির কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে। আর এই নয় দফার মাধ্যমেই সরকার পতনের আন্দোলনের সূচনা হয়।
দেশজুড়ে কারফিউ
২০ জুলাই শনিবার দেশজুড়ে কারফিউ, সেনা মোতায়েন করা হয়। একই সঙ্গে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে চলতে থাকে সংঘর্ষ, ধাওয়া ও গুলি। উলেখযোগ্য স্থান হচ্ছে, যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, বাড্ডা ও মিরপুর। এছাড়া মোহাম্মদপুরেও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে শনিবারই নিহত হন ২৬ জন। সব মিলিয়ে চারদিনে নিহত ১৪৮ জন।
২১ জুলাই আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদকে তুলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। এরপর অজ্ঞাত স্থান থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ইন্টারনেট সংযোগ চালু করাসহ চার দফা দাবি পূরণের জন্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা ৪৮ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিলেন।
একই দিনে বিরাজমান পরিস্থিতি নিয়ে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৫৬ সমন্বয়কের যৌথ বিবৃতি’ শিরোনামে একটি খুদে বার্তা গণমাধ্যমকর্মীদের মোবাইল ফোনে পাঠানো হয়। যৌথ বিবৃতিতে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ (সর্বাত্মক অবরোধ) কর্মসূচি আরও জোরদার করার আহ্বান, ২২ জুলাই কোটাপ্রথা সংস্কার করে আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী তৈরি করা প্রজ্ঞাপন অনুমোদন দেন প্রধানমন্ত্রী।
২৩ জুলাই মঙ্গলবার কোটা প্রথা সংস্কার করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। রাতে সীমিত আকারে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা চালু করা হয়। ২৪ জুলাই কোটা আন্দোলনের প্ল্যাটফরম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার ও রিফাত রশীদের খোঁজ পাওয়া যায়। ২৫ জুলাই অ্যামনেস্টি প্রতিবেদন দিয়ে বলে, প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করেছে পুলিশ। প্রধানমন্ত্রী ক্ষতিগ্রস্ত মেট্রো স্টেশন পরিদর্শন করে বলেন, আমি জনগণের কাছে বিচার চাইছি।
দেশব্যাপী ব্লকরেইড
২৬ জুলাই শুক্রবার এলাকা ভাগ করে ‘ব্লক রেইড’ দেওয়া হয়। সারা দেশে অভিযান চলে। সারা দেশে অন্তত ৫৫৫টি মামলা হয়। গ্রেফতারের সংখ্যা ছয় হাজার ২৬৪। চট্টগ্রামে ৩০ শিক্ষার্থী গ্রেফতারের খবর পাওয়া যায়। আসিফ মাহমুদসহ কোটা সংস্কার আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফরম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন সমন্বয়ককে রাজধানীর গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে নিজেদের হেফাজতে নেয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
একদল ব্যক্তি সাদা পোশাকে বেলা সাড়ে ৩টার দিকে ধানমন্ডির ওই হাসপাতাল থেকে তাদের তুলে নিয়ে যায়। সেসময় ওই ব্যক্তিরা নিজেদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয় দেন।
২৭ জুলাই শনিবার কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্ল্যাটফরম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরও দুই সমন্বয়ককে হেফাজতে নেয় ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। তারা হলেন সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহ।
২৮ জুলাই রোববার ডিবির হেফাজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয়জন সমন্বয়ক এক ভিডিও বার্তায় সব কর্মসূচি প্রত্যাহারের কথা বলেন বলে জানায় ডিবি। রাত ৯টার দিকে নাহিদ ইসলামসহ ছয় সমন্বয়কের ওই ভিডিও বার্তা আসার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পৃথক বার্তায় এ আন্দোলনের তিন সমন্বয়ক মাহিন সরকার, আব্দুল কাদের ও আব্দুল হান্নান মাসুদ বলেন, ‘অস্ত্রের মুখে ডিবি অফিসে ৬ সমন্বয়কের ভিডিও বিবৃতি নেওয়া হয়েছে। ডিবি অফিস কখনোই ছাত্রদের সংবাদ সম্মেলনের জায়গা নয়।’
২৯ জুলাই সোমবার জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত হয় ১৪ দলের বৈঠকে। ওদিকে ৬ সমন্বয়ক তখনো ডিবি হেফাজতে। সহিংসতায় নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে পরদিন মঙ্গলবার সারা দেশে শোক পালন করার সিদ্ধান্ত হয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে। তবে সরকার ঘোষিত মঙ্গলবারের রাষ্ট্রীয় শোক প্রত্যাখ্যান করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। এর বদলে এদিন একক বা ঐক্যবদ্ধভাবে লাল কাপড় মুখে ও চোখে বেঁধে ছবি তোলা এবং অনলাইনে প্রচার কর্মসূচির ঘোষণা করা হয়।
৩০ জুলাই মঙ্গলবার হত্যার বিচার চেয়ে মুখে লাল কাপড় বেঁধে মিছিল হয়। জাতিসংঘ মহাসচিবের বিবৃতিতে স্বচ্ছ তদন্তের আহ্বান জানানো হয়। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের প্রোফাইল লাল রঙের ফ্রেমে রাঙান অনেকে।
‘মার্চ ফর জাস্টিস’
অন্যদিকে সরকার সমর্থকদের অনেকে ফেসবুক প্রোফাইলে কালো রঙের ফ্রেম জুড়ে দেন। ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালন করার ঘোষণা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের। ৯ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে এ কর্মসূচি পালন করা হবে দেশের সব আদালত, ক্যাম্পাস ও রাজপথে। ৩১ জুলাই বুধবার মার্চ ফর জাস্টিস কর্মসূচির পর বৃহস্পতিবারের জন্য নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একাংশ।
এই দিনের কর্মসূচির নাম দেওয়া হয় ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোস’। ১ আগস্ট বৃহস্পতিবার গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হেফাজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে ছেড়ে দেওয়া হয়।
ফের বাঘের গর্জন
ডিবি হেফাজতে পুলিশের সাজানো সংবাদ সম্মেলন শেষে ছাড়া পান ছয় সমন্বয়ক। এরপর ফের বাঘের গর্জন শুরু হয়। রাতে ছাড়া পাওয়া অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে লেখেন, ‘ছয়দিনের ডিবি হেফাজত দিয়ে ছয়জনকে আটকে রাখা যায়, কিন্তু এই বাংলাদেশের পুরো তরুণ প্রজন্মকে কীভাবে আটকে রাখবেন? দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থ পাচার, ক্ষমতার অপব্যবহার করে যে ক্ষোভ সৃষ্টি করেছেন প্রতিনিয়ত, সেগুলো কীভাবে নিবৃত্ত করবেন?’ এদিন জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার।
২ আগস্ট শুক্রবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে জুমার নামাজের পর ‘দোয়া ও ছাত্র-জনতার গণমিছিল’ কর্মসূচি পালিত হয়। সারা দেশে এ কর্মসূচি পালিত হয়। এছাড়া এদিন ছিল শিক্ষক ও নাগরিক সমাজের ‘দ্রোহযাত্রা’ কর্মসূচি পালন। শিল্পীসমাজের ব্যতিক্রমী প্রতিবাদে শামিল হন সর্বস্তরের মানুষ। ৩ আগস্ট শনিবার সরকারের পদত্যাগের একদফা দাবিতে উত্তাল বাংলাদেশ।
ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জমায়েত হন শিক্ষার্থীসহ হাজারো জনতা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে রাজধানীসহ দেশজুড়ে জেলা ও মহানগরে বিক্ষোভ হয়। ৪ আগস্ট রোববার সরকার পদত্যাগের একদফা দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা সর্বাত্মক অসহযোগ কর্মসূচির প্রথমদিনে সারা দেশে ১৮ জেলায় ঘটে ব্যাপক সংঘাতের ঘটনা। এদিন ১১৪ জন শহীদ হন।
সেই মাহেন্দ্রক্ষণ
এরপর আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। মৃত্যুর মুখে বীরবিক্রমে স্বৈরশাসকের বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অকুতোভয় লাখ লাখ মানুষের বিজয়ের দিন। দিনটি ছিল ৫ আগস্ট বা ‘ছত্রিশে জুলাই’। সোমবার।
পদত্যাগ করে দুপুরে হেলিকপ্টারে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে স্বৈরাচার পতনের অফিশিয়াল খবর নিশ্চিত করেন। একই সঙ্গে ঘোষণা আসে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের।
এরপর জনতার বাঁধভাঙা জোয়ার আছড়ে পড়ে গণভবন ও সংসদ ভবনে। বাদ যায়নি ধানমন্ডির ৩২ নম্বরও। পলাতক প্রধানমন্ত্রীর শোবার বিছানা থেকে শুরু করে রান্নাঘর-সর্বত্র ছিল বিক্ষুব্ধ জনতার সরব উপস্থিতি। এভাবে মুক্তিকামী কোটি কোটি জনতা মহান মুক্তিযুদ্ধের পর আরেকবার স্বাধীনতার স্বাদ অর্জন করে বহু মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে। গণ-অভুত্থানের সম্মুখ সারিতে অংশ নেওয়া নতুন প্রজন্মের হাত ধরে যাত্রা শুরু হয় নতুন এক বাংলাদেশের।
প্রসঙ্গত, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এভাবে কোনো সরকারপ্রধান দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাননি। তবে এরকম এক দানবীয় সরকারকে হটাতে অনেক রক্ত ঝরাতে হয়েছে বাংলার অকুতোভয় বিপুলসংখ্যক ছাত্র-জনতাকে। দেড় হাজারের বেশি মানুষকে স্বৈরাচারের তপ্ত বুলেটে জীবন দিতে হয়। ন্যক্কারজনক এ হত্যাকাণ্ডে শিশু থেকে বৃদ্ধ-কেউই বাদ যায়নি। ঘরের মধ্যেও কেউ নিরাপদ ছিলেন না। বুলেটে আহত হতে হয় ৩০ হাজারের বেশি যোদ্ধাকে।
সারা জীবনের জন্য অনেককে অন্ধ ও পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে। ১৯৭১ সালের পর কোনো আন্দোলনে এত শহীদ ও হতাহতের সাক্ষী হয়নি বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে প্রথম ধাপের খসড়া তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৮৫৮ জন শহীদ এবং ১১ হাজার ৫৫১ জন আহতের নাম প্রকাশ করা হয়েছে।
Source: Jugantor