ইসলাম

পূজায় মুসলমানদের যাওয়া কি জায়েজ?

12037_IMG_1957.jpeg

বাংলাদেশের বহুধর্মীয় সমাজে প্রতিবছর পূজা-পার্বণ ঘিরে প্রশ্নটি নতুন করে আলোচনায় আসে—মুসলমান কি পূজায় যেতে পারে? উত্তরটি সরল নয়, বরং অটল ও অমোঘ না, কোনো অবস্থাতেই নয়। 

ইসলাম যে ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে, তার প্রথম ও প্রধান স্তম্ভ হচ্ছে তাওহিদ অর্থাৎ এক আল্লাহর এককত্বে বিশ্বাস। আর তাওহিদের বিরুদ্ধে সর্ববৃহৎ বিদ্রোহ হলো শিরক। পূজা মণ্ডপ হলো সেই জায়গা, যেখানে প্রকাশ্যে শিরক সংঘটিত হয়, যেখানে আল্লাহর বদলে মূর্তিকে উপাস্য বানানো হয়। একজন মুসলমান সেখানে গিয়ে উপস্থিত থাকা মানেই শিরককে প্রত্যক্ষ করা, আর সেটিই কুরআনের দৃষ্টিতে চরম অন্যায়। 

আল্লাহ ঘোষণা করেছেন, যখনই তোমরা আল্লাহর আয়াতসমূহকে অস্বীকার হতে বা উপহাস হতে শুনবে, তখন তাদের সঙ্গে বসো না, যতক্ষণ না তারা অন্য বিষয়ে প্রবৃত্ত হয়। অন্যথায় তোমরা তাদেরই মতো হয়ে যাবে। (সূরা আন‘আম: ৬৮) 

এ আয়াত স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিল যেখানে আল্লাহর সঙ্গে শিরক হয়, সেখানে বসা মানে নিজেকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করে ফেলা। 

রাসুলুল্লাহ (সা.) সতর্ক করে বলেছেন, যে ব্যক্তি কোনো জাতির সঙ্গে সাদৃশ্য রাখে, সে তাদেরই একজন। (আবু দাউদ, মুসনাদ আহমদ) 

পূজামণ্ডপে গিয়ে দাঁড়ানো, হাসিমুখে অংশ নেওয়া কিংবা সামান্য সৌজন্য প্রদর্শন করা এসবই ইসলামের চোখে সাদৃশ্যের শামিল। আর এই সাদৃশ্য মুসলমানকে টেনে নিয়ে যায় আখিরাতের ভয়ংকর গহ্বরে। 

ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ (রহ.) তার ইকতিদাউস সিরাতুল মুস্তাকীম গ্রন্থে লিখেছেন—অমুসলিমদের ধর্মীয় উৎসবে মুসলমানের অংশগ্রহণ শুধু হারামই নয়, বরং তা ঈমানি স্বকীয়তা ধ্বংসের শামিল। এটি এমন এক দরজা, যা একবার খুললে মুসলমানের হৃদয়ে ইসলামি আকিদার জায়গায় ঢুকে পড়ে সন্দেহ, ভ্রান্তি আর শিরক-সাদৃশ্য।কেউ যদি ভেবে নেয় ‘আমি শুধু সৌজন্যের জন্য যাচ্ছি, পূজা করছি না’ তবে সেটি আত্মপ্রবঞ্চনা ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ শরীয়ত কেবল পূজা করা নিষিদ্ধ করেনি, বরং পূজার পরিবেশে অবস্থানকেই হারাম ঘোষণা করেছে। সেখানে যাওয়া মানে অন্ততপক্ষে হৃদয়ে শিরকের প্রতি নীরব অনুমোদন দেওয়া। ইসলামের দৃষ্টিতে এটি ভয়ংকর অপরাধ, যা ঈমানের ভিত্তিকে কাঁপিয়ে দিতে পারে। 

 

অবশ্যই ইসলাম অন্য ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে সদাচরণ, ন্যায়বিচার ও মানবিক সহমর্মিতা বজায় রাখার নির্দেশ দিয়েছে। 

কুরআনে বলা হয়েছে,  তোমরা তাদের সঙ্গে সদাচরণ করবে এবং ন্যায়বিচার করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়পরায়ণদের ভালোবাসেন। (সূরা মুমতাহিনা: ৮) 

কিন্তু লক্ষ্য করুন এখানে সামাজিক সম্পর্কের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতায় শরিক হওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি। 

অতএব, পূজামণ্ডপে মুসলমানদের যাওয়া শরীয়তের আলোকে স্পষ্টত হারাম, অনৈতিক ও আকিদার জন্য ভয়াবহ হুমকি। মুসলমানের পরিচয় তার আকিদায়, আকীদার ক্ষুদ্রতম ভাঙনও তার সমগ্র ইসলামকে ধ্বংস করে দিতে পারে। তাই যারা ইসলামের নাম নেয়, তাদের জন্য পূজা মণ্ডপের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়াই ঈমান রক্ষার একমাত্র পথ।

পূজার বিষয়টিকে ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে যে কোনো মুসলমানের কাছেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে তার সঙ্গে কোনোরকম সংশ্লিষ্টতারই সুযোগ কোনো মুসলমানের নেই। 

রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামের শুরুর যুগে এ জাতীয় ধর্মাচারের বিরোধিতা করেই ইসলামের তাওহিদ তথা একত্ববাদের দিকে মানুষকে আহ্বান করেছেন। এবং সকল প্রকারের মূর্তি ও পূজাকে শিরিক আখ্যা দিয়ে তা থেকে বেঁচে থাকার তাগিদ দিয়েছেন। 

সুতরাং আকিদাগত বা বিশ্বাসগত দিক থেকে একজন মুওয়াহহিদ (একত্ববাদী মুসলিম)-এর জন্য পূজা-জাতীয় ধর্মাচারের সঙ্গে যুক্ত হওয়া, সমর্থন করা এবং সেটিকে নিজের উৎসবের বিষয় মনে করার কোনো সুযোগ ইসলামে নেই।

তবে এক ধর্মের সঙ্গে অপর ধর্মের অনুসারীদের সহাবস্থান এবং অন্য ধর্মের অনুসারীদের আপন আপন পূজা-আরাধনা নির্বিঘ্নে পালন করতে সহযোগিতার বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত পরিষ্কার। ইসলাম এতে পূর্ণ সমর্থন দেয় ও দায়িত্ব গ্রহণ করে। 

ইসলামের স্পষ্ট নীতি হচ্ছে, যে কোনো ধর্মাবলম্বী নিজস্ব গণ্ডির মধ্যে তার ধর্ম পালন করুক। নিজস্ব পরিধির মধ্যে তার ধর্ম পালনের পূর্ণ স্বাধীনতা তার রয়েছে। ইসলাম এক্ষেত্রে কোনো প্রকার অসহযোগিতা ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না। বরং তাদের নিজস্ব গণ্ডির ভেতরে থেকে এগুলো পালন করার জন্য ইসলামী সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতাও দেয়া হয়েছে ইসলামী খেলাফতের সময়গুলোতে। 

হযরত ওমর রা. তার শাসনামলে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের كنيسة  (কানীসা) বানানোর সুযোগও দিয়েছেন। সুতরাং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার এবং ধর্মীয় আচার-আচরণকে এক করে দেখার পেছনে যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ নেই। 

ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, প্রত্যেক ধর্মের নিজস্ব। এ উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব ও আনন্দও তাদের নিজস্ব। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের অন্যদের ধর্মীয় কাজে যোগ দেওয়া, সেগুলোকে পছন্দ করা, সে উৎসবকে নিজের উৎসব মনে করার কোনো একটি বিষয়ই শরীয়ত কর্তৃক সমর্থিত নয়।

মূলত অন্য ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে সহাবস্থান, নিজস্ব পরিধির মধ্যে তাদের ধর্মপালন ও পালনের অধিকার একটি সমর্থিত ও স্বীকৃত বিষয়। এটি ইসলামেরই নীতি। 

কিন্তু অপর ধর্মের ধর্মীয় আচার এবং ধর্মভিত্তিক উৎসবকে নিজের উৎসব মনে করা কিংবা সে উৎসবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেয়া সম্পূর্ণ অসমর্থিত, অযৌক্তিক ও বাস্তবতাবহির্ভূত। 

মূর্তিপূজা সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠান-উৎসবে কোনো মুসলমানের পক্ষে এভাবে একাত্মবোধ করার কোনো অবকাশই নেই। এটা ইসলামের অন্যতম প্রধান শিক্ষা এবং ভিত্তিগত চেতনারও বিরোধী।

তবে যদি রাষ্ট্রীয় দায়িত্বশীল হিসাবে বাধ্য-বাধকতা থাকে, সেক্ষেত্রে যিম্মীদের ধর্মীয় অধিকার রক্ষার্থে সেখানে যাওয়া যেতে পারে। কিন্তু কোন অবস্থায় যেন তাদের শিরকী আকিদা ও আমলের প্রতি সমর্থন সূচক কোন বক্তব্য না দেওয়া হয়। বরং তাদেরকে ঈমানের পথে দাওয়াত প্রদানের সদিচ্ছা থাকতে হবে (ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ২/১১৫)।



 

সর্বাধিক পঠিত


ভিডিও