একটি সাক্ষাৎকার নিয়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা। হচ্ছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। কী তিনি বলেছেন, কী তিনি বলেন নি, এতে নতুন কী আছে, বলার ভঙ্গি কী ছিল, সাক্ষাৎকারে আগামীর বাংলাদেশ নিয়ে কিছু আছে কিনা? প্রায় দু’ঘণ্টার এই সওয়াল জবাব শুনতে মুখিয়ে ছিল দেশের কোটি মানুষ। নেপথ্যের কারণ একটাই তিনি দীর্ঘ দেড় দশক পর মুখোমুখি হয়েছেন মিডিয়ার। উত্তর দিয়েছেন বেশ কিছু কৌতূহলের। বিবিসি বাংলার প্রশ্নের জবাবে তিনি ছিলেন আদ্যোপান্ত একজন বিনয়ী। ধী-চেতা ছিলেন প্রতিটি প্রশ্নের উত্তরে। থেমে থেমে কুশলী উত্তর দেয়া নিয়ে যদিও সন্তুষ্ট হতে পারেনি কিছু মহল। সোশ্যাল মিডিয়ায় এ নিয়েও চলছে যৎকিঞ্চিৎ লেখালেখি। তবে তিনি অর্গল ভেঙেছেন। নিজেকে মেলে ধরেছেন রাজনীতির এক পরিবর্তিত তপ্ত হাওয়ায়। অন্তত অর্ধশত প্রশ্নে তিনি ব্যাটিং করেছেন, কিছু বিষয়ের উত্তরে ছক্কাও মেরেছেন। তবু প্রশ্ন থেকে যায়, প্রত্যাশার পারদ উঠানামা করে। আরও কী কী তিনি বলতে পারতেন। আরও যে সকল ইস্যু তিনি স্পষ্ট করতে পারতেন।
এই দেড় দশকে নিজেকে রেখেছেন দূর প্রবাসে, আড়ালে। ভার্চ্যুয়ালি বক্তৃতা করেছেন, দলকে দুর্যোগ ও দুর্বিপাক থেকে বাঁচাতে নীতি ও কৌশল নিয়ে মাঠ তাতিয়েছেন। দেশ ছেড়েছিলেন এক/এগারোর জমানায়। ২০০৭ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর। মামলার ভারে অথৈ অবস্থা হয়েছিল হাসিনার জমানায়। দেশে ফিরলেই শাস্তির মুখোমুখি হতে হতো, এমন অসংখ্য পরোয়ানা লেখাই ছিল। তবু তিনি দমেন নি। নিজেকে কেবলই ভাঙা-গড়ায় শানিত করেছেন। রাজনীতির স্কুলিং নিয়ে বিএনপি’র তৃণমূল থেকে নানা স্তরে নিবিড় যোগাযোগ রেখেছেন। রাজনীতিতে শেষ বলে কথা নেই- এই আপ্ত বাক্যের নজির গড়েছেন। তার প্রকাশ কিছুটা হলেও ঘটেছে বিবিসি বাংলাকে দুই কিস্তিতে দেয়া সাক্ষাৎকারে।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, রাজনীতির এক ঘূর্ণি হাওয়ায় আসে এক/এগারো। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তারেক রহমানকে দেশ ছাড়তে হয়। বিরাজনীতি করণের একটি খেলা চলেছিল সে সময়। যদিও দৃশ্যপট বদলায় দ্রুতই। ২০০৭ থেকে ২০২৫ সাল। লম্বা নির্বাসনে যাওয়ার আগে তারেক রহমান দলের তৃণমূল চষে বেড়িয়েছেন। মাঠের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন করে তিনি বার্তা দিয়েছিলেন বিএনপি’র উদীয়মান নেতা হিসেবেও। এ সময় তরুণদের মাঝেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান। বেশ কিছু ইস্যুতে বিতর্কিত হয়েছিলেন। বিশেষ করে বিএনপি সরকারে থাকা অবস্থায় ২০০১ থেকে ২০০৬ সময়কালে হাওয়া ভবন ঘিরে বিতর্ক ছড়ায়। সে সময় মিডিয়ায় এ নিয়ে ব্যাপক লেখালেখিও হয়। রাজনীতির মাঠে জল গড়ায় অনেকদূর। সেনাসমর্থিত সরকারের সময় বিরাজনীতিকরণ নিয়েও তুমুল বিতর্ক চলে। দু’বছরের মধ্যেই ফের খোলনলচে বদলে যায়। মইন-ফখরুদ্দীনের বিদায়ে শেখ হাসিনা মসনদে বসেন। এরপর একের পর এক বিতর্কিত ভোটারবিহীন নির্বাচনে গণতন্ত্র ব্রাকেট বন্দি হয়ে পড়ে। বিনা ভোট, রাতের ভোট, ডামি ভোট বিতর্ক উত্তাপ ছড়াতে থাকে।
প্রেক্ষাপট বদলায়। ২০২৪ সাল নিয়ে আসে এক অভূত পরিবর্তন। শিক্ষার্থীদের কোটা আন্দোলন দিয়ে শুরু হলেও তা শেষ পর্যন্ত হাসিনার পতন আন্দোলনে রূপ নেয়। জুলাইতে গণ-আন্দোলনের ঢেউ ভাসিয়ে নেয় হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে। ৫ই আগস্টের পরিবর্তনে সূচিত হয় নতুন আকাঙ্ক্ষা। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বে আসেন প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। টানা দেড় দশক লন্ডনে নির্বাসনে থেকেও রাজনীতির টালমাটাল ঘটনাপ্রবাহে তারেক রহমান ছিলেন বিএনপি’র প্রকাশ্য এবং অপ্রকাশ্য কারিগর। এ সময়কালে বেগম জিয়ার বন্দি থাকা এবং তীব্র শারীরিক অবস্থার অবনতি, ছোট ভাই আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যু, তীব্র মানসিক চাপেও দলের ভেতরে বাইরে নানামুখী তৎপরতা সামলান দক্ষভাবে।
এ সময়কালে দলের প্রতিটি কার্যক্রমে নিজেকে যুক্ত করেছেন। দলের সংস্কার কর্মসূচি নিয়ে সরব ছিলেন। সঙ্গত কারণেই চব্বিশের ৫ই আগস্টের পর তার দেশে ফেরা নিয়ে চাপ বাড়ে। দলের নেতাকর্মীদের অপেক্ষার প্রহর বাড়তে থাকে। প্রত্যাশা তৈরি হয় আকাশচুম্বী।
বিবিসি’র সঙ্গে সাক্ষাৎকারে উঠে আসে দীর্ঘদিনের জমে থাকা এবং জিইয়ে থাকা অনেক প্রশ্ন। সাক্ষাৎকারে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশে ফেরা, আগামী নির্বাচনে দলের কৌশল, আওয়ামী লীগের রাজনীতি ও তাদের নেতাকর্মীদের বিচার, ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র সংস্কার, গণমাধ্যম ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক, অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রমের মূল্যায়ন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভূমিকা, ডাকসু নির্বাচন, বিএনপি’র ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, বাংলাদেশের নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতিসহ নানা ইস্যু নিয়ে কথা বলেন। সাক্ষাৎকার নিয়ে আলোচনা চলছে বিস্তর। এতে কী কী আছে আর কী কী নেই তা নিয়েও কথা হচ্ছে এন্তার।
সাক্ষাৎকারের ইতি ও নেতি
বিবিসি বাংলার সম্পাদক মীর সাব্বির ও সিনিয়র সাংবাদিক কাদির কল্লোলকে দেয়া তারেক রহমানের সাক্ষাৎকার বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তিনি দ্রুতই দেশে ফেরার কথা জানিয়েছেন। বলেছেন, দেশে ফিরে নির্বাচনে অংশ নেবেন। কিন্তু তিনি কবে ফিরছেন তা নির্দিষ্ট করেন নি। ৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাস্টারমাইন্ড নিয়ে খোলামেলা উত্তর দিয়েছেন তারেক রহমান। নিজে কোনোরকম কৃতিত্ব নেননি বরং বলেছেন, ’২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানে কোনো দল বা ব্যক্তি মাস্টারমাইন্ড ছিল না, মাস্টারমাইন্ড ছিল দেশের গণতন্ত্রকামী জনগণ। এখানেই দৃশ্যত তিনি দেশের সকল গণতন্ত্রকামী মানুষকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।
জুলাই আন্দোলন নিয়ে বলেছেন, আন্দোলনের প্রেক্ষাপট শুরু হয়েছে বহু বছর আগে থেকেই। এই আন্দোলনে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীরা, সেটি বিএনপি হোক বা অন্য রাজনৈতিক দলগুলো হোক, যারা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল, প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল বিভিন্নভাবে অবদান রেখেছে। এই আন্দোলনের ক্রেডিট দলমতনির্বিশেষে বাংলাদেশের জনগণের, কোনো একটি রাজনৈতিক দলের নয়। কুলাই আন্দোলন কোনো একক দলের নয় বা এর মাস্টার মাইন্ড নিয়ে যে বিতর্ক আছে তার অবস্থান স্পষ্ট করলেন সাক্ষাৎকারে।
ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যত দ্রুত নির্বাচন হবে যত দ্রুত দেশের মালিক যারা অর্থাৎ জনগণ তাদের কাছে যখন সেই অধিকার ফিরিয়ে দেয়া হবে, তারা যখন সিদ্ধান্ত নেবে, অর্থাৎ দেশের মালিক যখন সিদ্ধান্ত নিবে দেশ কারা কীভাবে পরিচালিত করবে, তত দ্রুত দেশে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে। নির্বাচন সামনে রেখে জোট গঠনের নানা তৎপরতা নিয়ে বলেন, কমবেশি সকলকে নিয়ে আমরা রাষ্ট্র গঠন করতে চাই। বাংলাদেশের যে সংবিধান এখনো যেটি আছে এই সবকিছুর ভেতরে থেকে অর্থাৎ মানুষের সমর্থন-গ্রহণযোগ্যতা সবকিছুর ভেতরে থেকে যারা রাজনীতি করবে তারা করতেই পারে।
নিজেকে একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে উল্লেখ করে তারেক রহমান বলেন, নির্বাচনের সঙ্গে তো রাজনৈতিক দল এবং রাজনৈতিক কর্মীর ওতপ্রোত সম্পর্ক। কাজেই নির্বাচন যেখানে একটি মানে জনগণের সম্পৃক্ত এরকম একটি নির্বাচন হবে, সেখানে তো অবশ্যই আমি নিজেকে দূরে রাখতে পারবো না। প্রধানমন্ত্রী পদের প্রত্যাশী কিনা- এমন প্রশ্নে তিনি বল ছুড়ে দিয়েছেন জনগণের কোর্টে।
মা সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া প্রসঙ্গে বলেছেন, যেই মানুষটি বাংলাদেশের গণতন্ত্র, যতবার গণতান্ত্রিক অধিকারকে হরণ করা হয়েছে, প্রতিবার উনি অবদান রেখেছেন। সেই গণতন্ত্রকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত বা পুনরুদ্ধার করার জন্য। উনার শারীরিক সক্ষমতা যদি অ্যালাও করে নিশ্চয়ই উনি কিছু না কিছু ভূমিকা রাখবেন।
বিএনপি’র ভবিষ্যৎ নেতৃত্বে পরিবারের প্রভাব কতোটা থাকবে- এমন প্রশ্নে অবস্থান স্পষ্ট করেছেন তিনি। বলেছেন, একজন চিকিৎসকের সন্তান যখন চিকিৎসক হয় তখন সে ভালোও করে, সে খারাপও করে। একজন ল’ ইয়ারের সন্তানও দেখা যায় যে, অনেক সময় বাবা-মায়ের মতন ভালো ল’ ইয়ার (আইনজীবী) হয় অথবা হয় না।
রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রে অনেকের সন্তান পলিটিক্সে এসেছে। সবাই কি ভালো করেছে? সবাই ভালো করেনি। কেউ কেউ করেছে, কেউ কেউ করতে পারেনি ভালো। দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম, জেল-জুলুম আর নির্যাতনের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, কোনোটার মধ্যদিয়ে আমি যাইনি? এর প্রতিটার ভেতর দিয়ে আমি গিয়েছি। প্রত্যেকটা স্তর পার করে এসেছি আমি। আমি শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়েছি। যেই নির্যাতনের চিহ্ন এখনো কখনো কখনো আমাকে সহ্য করতে হয়। জেল-জুলুম খেটেছি আমি। বিভিন্নভাবে মিথ্যা অপপ্রচারের শিকার হয়েছি। সবকিছুর ভেতর দিয়েই আমি পেরিয়ে এসেছি। কাজেই এজন্য এই কথাগুলো আমি বললাম যে, রাজনীতি পরিবারকরণ হয় না। এটি সমর্থনের ভিত্তিতে হয়। সময় পরিস্থিতি সবকিছু প্রমাণ করে দিবে। দুর্নীতি-চাঁদাবাজির অভিযোগে দলের সাত হাজারের মতো নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়ার তথ্য উল্লেখ করেছেন তিনি। যদিও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেয়ায় সমালোচনা করেছেন পুলিশের বিরুদ্ধে।
ডাকসু নির্বাচন প্রশ্নে তিনি বলেন, ছাত্ররাজনীতি ছাত্ররাজনীতির জায়গায়, জাতীয় রাজনীতি জাতীয় রাজনীতির জায়গায়। একাত্তরে জামায়াতের ভূমিকা প্রসঙ্গও এড়িয়ে যাননি তিনি। বলেন, বিগত ১৭ বছর গুম-খুন যারা করেছে, এর জবাব যেরকম তাদেরই দিতে হবে, ঠিক একইভাবে ’৭১ সালে কোনো রাজনৈতিক দল যদি তাদের কোনো বিতর্কিত ভূমিকা থেকে থাকে, তাহলে তাদের জবাব তারাই দিবেন।
১৭ বছরের প্রবাস জীবন, ওয়ান ইলেভেন, নিজেদের বেড়ে ওঠার স্মৃতি, মা সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ প্রসঙ্গ নিয়ে আবেগপ্রবণ ছিলেন সাক্ষাৎকারে। সকল অন্যায়, সকল হত্যা, সকল নির্যাতনের জন্য যারা দায়ী, যারা এসবের হুকুম দিয়েছে, তাদের প্রত্যেকের বিচার হবে বলেও উল্লেখ করেন। আওয়ামী লীগের রাজনীতি প্রশ্নে বলেন, জনগণ যদি সমর্থন না করে কোনো রাজনৈতিক দল বা রাজনৈতিক সংগঠনকে তাদের টিকে থাকার তো কোনো কারণ আমি দেখি না। যেহেতু জনগণের শক্তিতে আমরা বিশ্বাস করি, জনগণের সিদ্ধান্তে আমরা বিশ্বাস করি। জনগণের সিদ্ধান্তের ওপরে আমরা আস্থা রাখতে চাই। এ বিষয়ে সবচেয়ে বড় বিচারক আমি মনে করি জনগণ।
ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলে গণমাধ্যম ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হবে উল্লেখ করে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, বিএনপি’র অতীত সরকারের সময় যেরকম সাংবাদিকদের গুম করা হয়নি, সাংবাদিকদের নির্যাতন করা হয়নি, সাংবাদিকদের দেশ ছেড়ে যেতে হয়নি, বাধ্য হতে হয়নি। ইনশাআল্লাহ ভবিষ্যতেও হবে না।
ভারত প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ভারত যদি স্বৈরাচারকে আশ্রয় দিয়ে দেশের মানুষের বিরাগভাজন হয়, আমাদের কিছু করার নেই। এক/এগারোর সরকার ছিল একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত একটি সরকার। এ প্রসঙ্গে তিনি যুক্ত করেন, আমরা দেখেছি যে, কীভাবে তারা সবকিছু ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছিল, বিরাজনীতিকরণ করতে চেয়েছিল। দেশকে একটি অন্ধকারের দিকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। পরবর্তীতে দেখেছি যে, খুব সম্ভবত তাদেরই ভিন্ন আরেকটি রূপ; অন্যভাবে দেখেছি আমরা ‘ইন দি নেম অফ ডেমোক্রেসি’।
সংস্কার ইস্যুতে সকলের প্রতি সম্মান রেখেই তিনি বলেন, এই যে বাংলাদেশে রাষ্ট্র মেরামতের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কার প্রয়োজন। একজন ব্যক্তি দু’বারের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না, থাকবেন না। এরকম আরও যে বিষয়গুলো আছে, এগুলো বাংলাদেশে যখন স্বৈরাচার ছিল তাদের মুখের উপরে, তাদের চোখের দিকে চোখ রেখে আমরা বিএনপিই বলেছিলাম। এখন হয়তো অনেকে সংস্কারের কথা বলছেন। সেদিন কিন্তু সংস্কারের ‘স’-ও তারা বলেননি। তারপরেও সকলের প্রতি পরিপূর্ণ শ্রদ্ধা রেখে আমি বলতে চাই যে, বিএনপি ‘নোট অফ ডিসেন্ট’ দিলে সেটি সমস্যা, অর্থাৎ বিএনপিকে এগ্রি (সম্মত) করতে হবে সবার সঙ্গে, তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু বিএনপি যদি কোনোটার সঙ্গে একমত না হয়, তাহলে বেঠিক। এটি তো গণতন্ত্র হলো না।
মানে, আমাকে অন্যের সঙ্গে একমত হতে হবে, তাহলে গণতন্ত্র। আমি যদি অন্যের সঙ্গে দ্বিমত করি, তাহলে গণতন্ত্র না। এটি কেমন গণতন্ত্র? কারণ গণতন্ত্রের মানেই তো হচ্ছে, বিভিন্ন মতামত থাকবে। আমরা অনেক ব্যাপারেই একমত হবো হয়তো। সকল ব্যাপারে একমত হবো না, কিছু ব্যাপারে হয়তো দ্বিমত থাকতেই পারে, এটাই তো গণতন্ত্র, এটাই তো এসেন্স অব গণতন্ত্র।
বিএনপি যেগুলোতে একমত হয়েছে, প্রথমে আমরা সেগুলোর ওপরেই জোর দিবো। সেটা আপনি যে নামেই বলেন না কেন, স্বাভাবিকভাবে আমরা ঐকমত্য কমিশনে যেগুলোতে সকলে মিলে একমত হয়েছি, আমরা প্রথমে সেগুলোতে ইনশাআল্লাহ সরকার গঠনের সুযোগ পেলে প্রথমে সেগুলোতেই অবশ্যই জোর দিবো। ভবিষ্যতে সরকার পরিচালনার সুযোগ পেলে চলমান ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে হওয়া ঐকমত্যের বিষয়ের ওপর জোর দেয়া হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিএনপি’র অগ্রাধিকার বিষয় হলো সবার আগে দেশ।
সব ছাপিয়ে আগামীদিনে জুলাই আন্দোলন পরবর্তীতে তরুণদের যে আক্ষাঙ্ক্ষা বৈষম্যবিরোধী বাংলাদেশ গড়া, সেই নতুন বাংলাদেশ গড়তে তারেক রহমান নিজেকে কতোখানি বদলেছেন তারই ইঙ্গিত রয়েছে বলে মনে করছেন অনেকেই।
সাক্ষাৎকারে বাদ যায়নি পোষা প্রাণীর প্রতি সংবেদনশীলতাও। লন্ডন থেকে ঢাকার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগের মধ্যস্থতায় পরিবারের সহযোগিতাও কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন তিনি। সামাজিক মাধ্যম প্রসঙ্গে বলেন, অবশ্যই প্রত্যেকটি মানুষের অধিকার আছে। যেহেতু আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। মানুষের বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতায় আমরা বিশ্বাস করি। প্রত্যেক মানুষের অধিকার আছে, তার মতামত প্রকাশ করার। নিজেদের ভুল- ত্রুটি স্বীকার করে আগামীতে অতীত থেকে শিক্ষা নেয়ার কথাও বলেন। ভুল স্বীকারের যে সংস্কৃতি আমাদের এখানে অনুপস্থিত তা ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সকলের উদ্দেশে বলে নতুন এক সংস্কৃতির যাত্রা করলেন বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে বিএনপি ক্ষমতায় এলে অর্থনীতি কীভাবে গড়ে তুলবে তা অনেকটাই অনুপস্থিত ছিল। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বিএনপি’র পেছনের জমানায় কোথাও কোথাও বাধাগ্রস্ত হয়েছিল কিনা সে প্রশ্নও তুলেছেন অনেকে।
সব ছাপিয়ে আগামীদিনে জুলাই আন্দোলন পরবর্তীতে তরুণদের যে আক্ষাঙ্ক্ষা বৈষম্যবিরোধী বাংলাদেশ গড়া, সেই নতুন বাংলাদেশ গড়তে তারেক রহমান নিজেকে কতোখানি বদলেছেন তারই ইঙ্গিত রয়েছে বলে মনে করছেন অনেকেই। বিশেষত প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে লন্ডনে হাই ভোল্টেজ বৈঠকের পর নেতাকর্মীদের প্রত্যাশা বহুগুণ বাড়িয়েছেন তারেক রহমান। বলাবলি আছে, নির্বাচন নিয়ে যে দোদুল্যমানতা বা দ্বিধা তা নিরসনে এই বৈঠক বিরাট ভূমিকা রেখেছে।
তারেক রহমানের নির্বাসিত জীবনের বেশ কিছু ছবি পরিবর্তনের কথা জানান দিচ্ছে বলেও মনে করেন অনেকে। সাধারণ যাত্রী হিসেবে বাসের জন্য অপেক্ষা, মায়ের চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতালে খাবার নেয়া, মাকে নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে বাসায় নিয়ে যাওয়া, জুমে ভার্চ্যুয়ালি মিটিং চলার সময় পোষা বিড়ালকে স্নেহের পরশে মাতিয়ে রাখা। একান্ত ব্যক্তিগত প্রসঙ্গের বাইরে, বক্তৃতা বিবৃতিতে কটুবাক্য পরিহার, দোষারোপের প্রচলিত রাজনীতিকে অচল করার প্রাণান্ত চেষ্টা লক্ষ্য করা যায় তারেক রহমানের মধ্যে। দীর্ঘ দেড় যুগ পর প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে সামান্য কিছু ঘাটতি বাদ রাখলে একজন ব্যক্তি তারেক রহমান ধীরে ধীরে যেভাবে নিজেকে জনগণের অভিব্যক্তির কাছে সমর্পণ করেছেন তা লক্ষণীয়। ইতিমধ্যেই তারেক রহমান তার সাম্প্রতিক একাধিক বক্তব্যে একটি উদার গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। রাষ্ট্র মেরামতে দিয়েছেন ৩১দফা সংস্কার কর্মসূচি।
মানবজমিন প্রকাশিত রাজনৈতিক সাময়িকী ‘জনতার চোখ’ ২০০৭ সালের শুরুতে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন করেছিল ‘তারেক রহমান একটি সম্ভাবনার নাম ছিল’। যা ছিল তরুণ তারেক রহমানকে ঘিরে প্রাপ্তি ও প্রত্যাশার বিশ্লেষণ। সময় গড়িয়েছে অনেক। বাংলাদেশের রাজনীতিতেও নতুন নতুন বাস্তবতা স্থান করে নিচ্ছে প্রতিনিয়ত। আশা জাগানিয়া বিষয় হচ্ছে, সকল সঙ্কট উতরে আগামীদিনেও সম্ভাবনার বড় অংশ জুড়েই থাকবেন তারেক রহমান।
লেখাটি শেষ করতে চাই Walter Begehot এর অতি প্রচলিত একটি উক্তির উল্লেখ করে- The Greatest pain of human nature is the pain of new ideas. বিবিসি’র সঙ্গে দেয়া দীর্ঘ এই সাক্ষাৎকার নিয়ে নানা মহলে আলোচনা অব্যাহত থাকবেই। তবে ইতি ও নেতি’র তুলনামূলক আলোচনায় বাজি ধরলে এতে ইতি’ই সন্দেহাতীতভাবে জয়ী হবে।