
ব্রিটেনের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল স্যার রিচার্ড নাইটন এক অভূতপূর্ব স্পষ্ট ও কঠোর সতর্কবার্তায় বলেছেন, রাশিয়ার সামরিক শক্তি দ্রুত বাড়ছে এবং দেশটি এখন যুক্তরাজ্যের জন্য একটি বাস্তব ও ভয়ের কারণ হয়ে উঠেছে। ইউক্রেনে প্রায় চার বছর ধরে চলমান পূর্ণমাত্রার যুদ্ধে অংশ নিয়ে রুশ সেনারা এখন যুদ্ধ–অভিজ্ঞ ও আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, রাশিয়ার পক্ষ থেকে যুক্তরাজ্যের ওপর সরাসরি হামলার ঝুঁকি এখনো তুলনামূলকভাবে কম হলেও তা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাই দেশের “পুত্র ও কন্যাদের” প্রয়োজনে লড়াইয়ের জন্য মানসিক ও বাস্তব প্রস্তুতি নিতে হবে। ব্রিটিশ সশস্ত্র বাহিনী ও ন্যাটো জোট থাকবে প্রথম প্রতিরক্ষাবলয় হিসেবে, তবে জাতির সার্বিক স্থিতিশীলতা ও প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে তুলতে সমাজের সব স্তরের অংশগ্রহণ অপরিহার্য।
স্যার রিচার্ড নাইটন বলেন, সাধারণ পরিবার ও গৃহস্থালীর কাছে সত্যটা স্পষ্টভাবে তুলে ধরা জরুরি—যুদ্ধ কেবল দূরের কোনো ধারণা নয়, বরং এটি বাস্তব ও শারীরিক হুমকির রূপ নিতে পারে। তিনি ফ্রান্সের সেনাপ্রধান জেনারেল ফাবিয়েন মাঁদোর বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন, প্রয়োজনে যুদ্ধের মাশুল হিসেবে সন্তান হারানোর মানসিক প্রস্তুতিও জাতিকে রাখতে হবে।
তার ভাষায়, “আমার কর্মজীবনে বর্তমান পরিস্থিতি এতটা বিপজ্জনক কখনো ছিল না। শান্তি রক্ষার মূল্য এখন ক্রমেই বাড়ছে।” তিনি জোর দিয়ে বলেন, শুধু সামরিক শক্তি বাড়ালেই হবে না, বরং একটি ‘সম্পূর্ণ জাতিগত প্রতিক্রিয়া’ দরকার, যেখানে প্রতিরক্ষা শিল্প, দক্ষ মানবসম্পদ, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এবং জরুরি অবস্থায় কার্যকর অবকাঠামো একসঙ্গে কাজ করবে।
তিনি আরও বলেন, ঠান্ডা যুদ্ধের অবসানের পর প্রায় ৩৫ বছর ধরে যে শান্তিপূর্ণ সময়কাল ব্রিটিশ সমাজ উপভোগ করেছে, তার ফলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সামরিক অভিজ্ঞতার দূরত্ব তৈরি হয়েছে। জাতীয় পরিষেবার শেষ ডাক পড়েছিল ৬৫ বছর আগে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে ৮০ বছর আগে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের আগ পর্যন্ত যে জাতীয় প্রতিরক্ষা ও সামাজিক প্রস্তুতির চর্চা ছিল, তা আবার ফিরিয়ে আনার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।
রাশিয়ার সামরিক সক্ষমতা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে স্যার রিচার্ড বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লেও রাশিয়ার ‘হার্ড পাওয়ার’ কমেনি, বরং বেড়েছে। বর্তমানে রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনীতে ১১ লক্ষের বেশি সেনা রয়েছে এবং দেশটি জিডিপির সাত শতাংশেরও বেশি প্রতিরক্ষায় ব্যয় করছে, যা মোট সরকারি ব্যয়ের প্রায় ৪০ শতাংশ। গত এক দশকে এই ব্যয় দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। তুলনামূলকভাবে যুক্তরাজ্যের সেনাবাহিনীর সদস্য সংখ্যা মাত্র ৭০ হাজারের কিছু বেশি এবং প্রতিরক্ষা ব্যয় জিডিপির ২.৫ শতাংশে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে ২০২৭ সালের মধ্যে।
তিনি সতর্ক করে বলেন, রাশিয়া এখন প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত ও যুদ্ধ–অভিজ্ঞ এক বিশাল সামরিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। দেশটি পারমাণবিক সক্ষম টর্পেডো, পারমাণবিকচালিত ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র এবং মহাকাশে পারমাণবিক অস্ত্র স্থাপনের মতো অস্থিতিশীল অস্ত্রব্যবস্থাও উন্নয়ন করছে। এসবই প্রমাণ করে যে রাশিয়ার সামরিক শক্তি সত্যিই ভয়ের কারণ।
রাশিয়ার উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধ এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর বিরুদ্ধে আগ্রাসী মনোভাব স্পষ্টভাবে দেখায় যে মস্কো ন্যাটোকে চ্যালেঞ্জ জানাতে, বিভক্ত করতে এবং শেষ পর্যন্ত ধ্বংস করতে চায়। যদিও যুক্তরাজ্যে এই হুমকির প্রভাব এখনো সীমান্তবর্তী দেশগুলোর মতো তীব্র নয়, তবু প্রকৃত অর্থে ঝুঁকি আলাদা কিছু নয়।
স্যার রিচার্ড নাইটন উল্লেখ করেন, জার্মানি ২০২৯ সালের মধ্যে প্রতিরক্ষায় জিডিপির ৩.৫ শতাংশ ব্যয় করার পরিকল্পনা করছে এবং পোল্যান্ড ইতোমধ্যে ৪.২ শতাংশে পৌঁছেছে। ফ্রান্স ও জার্মানিও সম্প্রতি জাতীয় পরিষেবার একটি রূপ পুনরায় চালুর পথে হাঁটছে।
তার মতে, সমাজে ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি না করতে পারলে সরকার, শিল্প ও সাধারণ মানুষকে প্রয়োজনীয় ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত করা যাবে না। এই প্রেক্ষাপটে রাশিয়ার সম্ভাব্য হামলা নিয়ে সিমুলেশনভিত্তিক ‘দ্য ওয়ারগেম’ পডকাস্টের মতো উদ্যোগকে তিনি জনসচেতনতা বৃদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেন।