বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ফের পূরণ করতে এবং আমদানি বিল পরিশোধে বাজেট সহায়তার জন্য চীনের কাছ থেকে সহজ শর্তে ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ পেতে বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধের সিদ্ধান্ত বিভ্রান্তিকর হলেও বিস্ময়কর নয়।
বিভ্রান্তিকর এই কারণে যে, বাংলাদেশ এর আগে চীনের কাছ থেকে বিশেষ করে এত বড় অঙ্কের সহজ শর্তে ঋণ চায়নি। বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশ বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য চীন থেকে ঋণ নিয়েছে। এগুলো মূলত ‘সাপ্লায়ার ক্রেডিট’ এবং চীনের অর্থ ছাড়ের সর্বোচ্চ পরিমাণ ছিল (২০২৩ অর্থবছরে) ১.১ বিলিয়ন ডলার।
যাই হোক না কেন, দেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকট বিবেচনায় বাংলাদেশের সহজ শর্তে ঋণ চাওয়ার সিদ্ধান্তে বিস্মিত হওয়ার সুযোগ নেই। বিদেশি রিজার্ভ কমে যাওয়া, জিডিপি প্রবৃদ্ধির নিম্নগতি এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ঋণ পেতে দৌড়াচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। দেশটির ঋণের (পরিশোধের) বাধ্যবাধকতা মেটানোর জন্য অর্থের প্রয়োজন৷ একটি বাংলাদেশি থিঙ্ক ট্যাঙ্কের মতে, এই বাধ্যবাধকতা মেটাতে দেশটি আরও বেশি করে ঋণের আশ্রয় নিচ্ছে। আর এভাবে, দেশের ভবিষ্যৎ বন্ধক রেখে হয়তো একটা দুষ্টচক্র তৈরি হচ্ছে।
চীনের কাছে বাংলাদেশের অনুরোধের খবরটি এমন এক সময়ে এলো যখন বাংলাদেশ এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) স্টাফ-লেভেলে আলোচনা করেছে এবং বাংলাদেশকে মোট ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের তৃতীয় ধাপ ১.৪ বিলিয়ন ডলার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ কিছু শর্ত পূরণ করছে বলে আইএমএফ ঋণ ছাড় দিচ্ছে। ওইসব শর্তগুলোর মধ্যে কয়েকটি আবার সাধারণ মানুষের জন্য খুবই ক্ষতিকর – যেমন, জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি। ইতিমধ্যেই গত বছরে বিদ্যুতের খরচ তিনগুণ বেড়েছে। চলতি বছরের শেষ নাগাদ আরও চার ধাপে মূল্য বৃদ্ধির আশা করা হচ্ছে।
ঋণ পেতে সরকারের পদক্ষেপগুলো অর্থনৈতিক মন্দা এড়াতে এবং ২০১১ সাল থেকে ঋণ নেওয়ার প্যাটার্নের সাথে মানানসই করতে ২০২২ সালের গ্রীষ্ম থেকে তাদের যে প্রচেষ্টা তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
২০১১ এবং ২০২৩ অর্থবছরের মধ্যে, মোট এক্সটারনাল আউটস্ট্যান্ডিং পাবলিক অ্যান্ড পাবলিকলি গ্যারান্টেড (পিপিজি) ঋণ তিনগুণ বেড়েছে। ডেবট সার্ভিসিং বৃদ্ধি পেয়েছে ২.৬ গুণ। দেশীয় ঋণও লাফিয়ে বেড়েছে।
চীনের কাছে সহজ শর্তে ঋণের যে অনুরোধ, তার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে।
বাংলাদেশে চীনের ক্রমবর্ধমান পদচিহ্ন এবং গত এক বছরে তার অর্থনৈতিক পরাক্রম প্রদর্শন গণমাধ্যম ও জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে। একটি ওয়াশিংটন-ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক- আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট (এইআই) গত বছর অনুমান করেছিল যে, বাংলাদেশে মোট চীনা বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৭.০৭ বিলিয়ন ডলার। উপরন্তু, চীনা কোম্পানিগুলো নানান খাতে ২২.৯৪ বিলিয়ন ডলারের নির্মাণ চুক্তি পেয়েছে। বাংলাদেশ-চীন বাণিজ্য অত্যন্ত ভারসাম্যহীন, চীন যেখানে (২০২৩ অর্থবছরে) বাংলাদেশে ২২.৯০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করেছে সেখানে দেশটি থেকে আমদানি করেছে মাত্র ৬৭৭ মিলিয়ন ডলারের পণ্য।
চীনের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)-এর অধীনে অবকাঠামো প্রকল্পে বিনিয়োগকে ‘ঋণের ফাঁদ’ নামে সমালোচনা করা হয়ে থাকে। এই ঋণ অনেক দেশের জন্য অর্থনৈতিক কষ্টের কারণ হয়ে উঠেছে, যা তাদেরকে সার্বভৌমত্বের নীতির সাথে আপস করতে বাধ্য করেছে। ২০২৩ সালে প্রকাশিত অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) এর এক বিশ্লেষণ অনুসারে, চীন থেকে ঋণ নেওয়া দেশগুলোর ওই অর্থ বিদেশি ঋণ পরিশোধে ব্যয় করার প্রবণতা রয়েছে।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে, চীন থেকে ঋণ নেওয়ার ফলে আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংকের মতো বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কোনো দেশের সম্পর্ক প্রভাবিত হয়েছে। চীনা ঋণের স্বচ্ছতার অভাব এবং উচ্চ ইএসজি (পরিবেশ, সমাজ এবং সুশাসন) ঝুঁকি রয়েছে- এমন প্রকল্পগুলোতে ওই ঋণের ব্যবহার গুরুতর প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। বাংলাদেশে চীনা অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পগুলোও এ ধরনের ঝুঁকি থেকে মুক্ত নয়। বরং, যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক গবেষণা ল্যাব এইডডাটা অনুসারে, দেশের ৫৯ শতাংশ বিআরআই প্রকল্প ইএসজি ঝুঁকির সম্মুখীন। উল্লেখযোগ্যভাবে ইএসজি ঝুঁকির সম্মুখীন এই পোর্টফোলিওর অনুপাত নাটকীয়ভাবে বেড়েছে: ২০১৫ সালে ১ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ১২ বিলিয়ন ডলারের উপরে। উপরন্তু, বহুপাক্ষিক এজেন্সিগুলোর ঋণের তুলনায় চীনা ঋণ পরিশোধে হাতে সময়ও কম থাকে।
এমন অভিযোগও রয়েছে যে, চীনা ঋণের ব্যবহার কঠোরভাবে যাচাইয়ের অনুপস্থিতি দুর্নীতিকে উৎসাহিত করে। গবেষণায় দেখা গেছে, চীনা ঋণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অপব্যবহারের পাশাপাশি জবাবদিহিতা হ্রাস করার প্রবণতাও রয়েছে। এইডডাটা-এর পরিসংখ্যানের উপর ভিত্তি করে আন্ড্রিয়াস কার্ন, বার্নহার্ড রেইন্সবার্গ এবং প্যাট্রিক ই. শিয়া ২০২২ সালের এক গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, একই সাথে চীনা ঋণ গ্রহণ এবং আইএমএফ প্রোগ্রামে অন্তর্ভুক্ত হওয়া সুশাসনের জন্য অত্যন্ত সমস্যাযুক্ত এবং তাতে দুর্নীতিগ্রস্ত নেতারা উৎসাহিত হয়।
চীন থেকে ঋণ এবং বিনিয়োগে বিশেষ করে ঋণের ক্ষেত্রে- নিজ প্রভাবের ক্ষেত্র বাড়ানোর রাজনৈতিক এজেন্ডা থাকে। গত এক দশকে 'সফট পাওয়ার' ব্যবহার করে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতি চীনের দৃঢ় নীতির বিষয়টি সহজেই বোঝা যায়। চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ার বাংলাদেশের সিদ্ধান্ত থেকে বোঝা যায় যে বেইজিং এই দেশটিতে এবং এই অঞ্চলে আরও (বেশি করে) প্রবেশ করছে।
এটি লক্ষণীয় যে সিদ্ধান্তটি ২০২৪ সালের নির্বাচনের কয়েক মাসের মধ্যে এসেছে। নির্বাচনের আগে, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক 'শক্তিপরীক্ষা'র বিষয়ে আলোচনা ছিল। চীন শেখ হাসিনা সরকারের প্রতি তার অবিচল সমর্থন প্রসারিত করেছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র অবাধ, সুষ্ঠু এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের উপর জোর দিয়েছে। কিছু বিশ্লেষক যুক্তি দিয়েছিলেন যে, বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে সমর্থনকারী মার্কিন নীতি বিপরীতমুখী হবে কারণ এটি হাসিনাকে চীনের কাছাকাছি যেতে প্ররোচিত করবে।
ভারত, যে কিনা ২০০৯ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রী হাসিনাকে অকুন্ঠ সমর্থন দিয়ে এসেছে; জোর দিয়ে বলেছিল যে, চীনের দিকে হাসিনার সম্ভাব্য গমন রোধ করতে যুক্তরাষ্ট্রকে পিছু হটতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র ০৭ জানুয়ারি নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে দৃশ্যত পিছিয়ে গেছে। স্পষ্টতই, ভারতীয় যুক্তি ছিল যে, তারা হাসিনা সরকারের উপর চীনা প্রভাবকে ধারণ করতে সক্ষম হবে যদিও গত এক দশকের রেকর্ড (সে রকম) কোনো সফলতার ইঙ্গিত দেয় না।
২০০৯ সালের পর বাংলাদেশে চীনের প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায় যে সময়টাকে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ‘স্বর্ণযুগ’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। এর সাথে বাংলাদেশ ও চীনের আসন্ন যৌথ সামরিক মহড়া এবং তিস্তা প্রকল্পে চীনের সম্পৃক্ততার সম্ভাবনা এই ইঙ্গিত দেয় যে বাংলাদেশে ভূ-রাজনৈতিক ‘গ্রেট গেম’ আরও তীব্র হবে।
ঋণের জন্য বাংলাদেশের অনুরোধে চীন সাড়া দেবে কিনা তা এখনও বলা যাচ্ছে না। তবে, বাংলাদেশ এবং চীন- উভয় সরকারের স্বচ্ছতার অভাবের যে রেকর্ড তার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশিরা হয়তো জানেন না যে কী ঘটেছে। যাই হোক, সুপরিচিত বিষয়টা হল- বাংলাদেশের কোনো ফোরামে সরকারকে এটা ব্যাখ্যা করতে হয় না যে- কেন বহুপাক্ষিক সংস্থা থেকে নেওয়া ঋণের পাশাপাশি চীনের কাছ থেকে ঋণ নিতে হবে। এটা বলাই যায় যে, বাংলাদেশ যে ঋণ চাচ্ছে তার সাথে কি শর্তাবলী সংযুক্ত করা হচ্ছে তা নাগরিকরা জানেন না। ঋণ পরিশোধের চাপে পড়া বাংলাদেশ আগের ঋণের সাথে কেন এই ঋণ যোগ করছে তা নিয়েও আলোচনা করা হবে না।
যাদের আর্থিক ও রাজনৈতিকভাবে এই (ঋণের) বোঝা বহন করতে হবে তাদের কোনো কথা না শোনেই সরকার একতরফাভাবে এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারার কারণ- জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থার অনুপস্থিতি।
[যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট আলী রীয়াজের এই লেখাটি ওয়াশিংটন ডি.সি. ভিত্তিক খ্যাতনামা ‘দ্য ডিপ্লোম্যাট’ ম্যাগাজিনে ০৯ মে প্রকাশিত হয়েছে। অনুবাদ করেছেন তারিক চয়ন]