বাংলাদেশ

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে দোটানা

9531_IMG_9346.jpeg

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবি পূরণ হওয়ার পর আন্দোলন নিয়ে দোটানায় পড়েছেন শিক্ষার্থীরা। সরকার মূল দাবি মেনে নেওয়ায় একটি অংশ আর আন্দোলন অব্যাহত রাখতে চাইছে না। তবে পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে নতুন দাবি নিয়ে কর্মসূচি চালিয়ে যেতে চাইছেন অন্যরা। ইতোমধ্যে আন্দোলন থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) হেফাজতে থাকা অবস্থায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৬ জন সমন্বয়ক আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন। তবে সমন্বয়কদের এমন ঘোষণা দিতে বাধ্য করা হয়েছে দাবি করে কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার কথা বলছেন আন্দোলনকারীদের প্ল্যাটফর্মটির অন্য কয়েকজন নেতা।

এদিকে, ‘যৌক্তিক আন্দোলনের দাবির মুখে ২৩ জুলাই প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে আংশিক বিজয় অর্জিত হয়েছে’ উল্লেখ করে সারা দেশে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনাসহ একাধিক দাবি জানিয়েছে ‘সাধারণ শিক্ষার্থী মঞ্চ’ নামে নতুন একটি প্ল্যাটফর্ম। যদিও এই প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোনো সম্পর্ক বা সম্পৃক্ততা নেই বলে জানিয়েছেন কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়করা। অন্যদিকে, কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সমন্বয়করা সংবাদ সম্মেলন করে এই আন্দোলন থেকে সরে আসার ঘোষণা দিয়েছেন। এসব বিষয় শিক্ষার্থীদের দোটানায় ফেলেছে। আন্দোলন নিয়েও সন্দিহান অনেক শিক্ষার্থী।

গত রোববার সন্ধ্যায় ডিবি কার্যালয়ে নিরাপত্তা হেফাজতে থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ, আবু বাকের মজুমদার, আসিফ মাহমুদ ও নুসরাত তাবাসসুম তাদের কর্মসূচি প্রত্যাহারের তথ্য জানিয়ে বিবৃতি দেন। পাশাপাশি তারা একটি ভিডিওবার্তায় আন্দোলন প্রত্যাহারের বিবৃতিটি পড়ে শোনান। এর প্রতিক্রিয়ায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন সমন্বয়ক ও সহ-সমন্বয়ক তাদের ফেসবুক টাইমলাইনে পোস্ট করে দাবি করেন, জোর করে ওই বিবৃতি দেওয়ানো হয়েছে। সে কারণে এটি গ্রহণযোগ্য নয়। তাদের মধ্যে ছিলেন সমন্বয়ক আব্দুল কাদের, আব্দুল হান্নান মাসউদ, মাহিন সরকার, সহ-সমন্বয়ক রিফাত রশীদ, আব্দুল্লাহ সালেহীন অয়ন প্রমুখ। এরপর রোববার রাতে সমন্বয়ক আব্দুল কাদেরের স্বাক্ষরে বিবৃতি দিয়ে আন্দোলনকারীরা বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশের ঘোষণা দেন। সে অনুযায়ী গতকাল সোমবার দেশের বেশ কয়েকটি স্থানে সমবেত হন কিছু শিক্ষার্থী।

রাজধানী ঢাকার কয়েকটি স্পটের পাশাপাশি চট্টগ্রাম মহানগরী, ঠাকুরগাঁও, নোয়াখালী ও ফেনীতে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন আন্দোলনকারীরা। বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই কর্মসূচি ঘিরে কিছু জায়গায় সংঘর্ষ হয়েছে। আবার কোথাও আন্দোলনকারীদের ওপর হামলারও অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ সময় বেশ কয়েকজন আন্দোলনকারীকে আটক করে পুলিশ।

কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা: গত ২৫ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় ও হল খুলে দেওয়াসহ কয়েকটি দাবি পূরণে ৩০ দিনের আলটিমেটাম দিয়ে সব কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা কয়েকজন। তবে তাদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে গত রোববার ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন ‘সমন্বয়ক কমিটি’ গঠন করেছেন অন্যরা।

অন্যদিকে, গত ২৭ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলন করে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ও নানা বাস্তবতায় আপাতত কোনো কর্মসূচি নেই বলে জানান বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ক সুজয় বিশ্বাস শুভ। তবে তারা হল খুলে দেওয়া, শিক্ষার্থীদের হয়রানি বন্ধসহ চার দফা দাবিও জানান।

ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত সাংবাদিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা জানান, কর্মসূচি থেকে পুরোপুরি সরে আসেননি আন্দোলনকারীরা। গত রোববার গ্রাফিতি ও দেয়াল লিখন কর্মসূচিতে তারা অংশ নিয়েছেন।

গতকাল বিকেলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বরিশাল শাখার সমন্বয়ক সুজয় শুভ সাংবাদিকদের বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের পক্ষে গত শনিবার সংবাদ সম্মেলন করেন তারা। কিন্তু কিছু পত্রিকায় উল্টো সংবাদ আসে। এ নিয়ে পরবর্তী করণীয় নিয়ে আলোচনা করতে তারা সোমবার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের নিচতলায় অবস্থান করছিলেন। এ সময় হঠাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত এ কে আরাফাতের নেতৃত্বে ৪০ থেকে ৫০ জন লাঠিসোটা নিয়ে অতর্কিতে হামলা চালায়। হামলাকারীরা বেধড়ক পিটিয়ে অন্তত ১৫ জনকে আহত করে।

গত রোববার বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) ক্যাম্পাসে কোটা সংস্কার আন্দোলন কর্মসূচি প্রত্যাহার ঘোষণা করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যারা আন্দোলন প্রত্যাহার ঘোষণা করেছে, তারাই শুরু থেকে আন্দালনে নেতৃত্ব দিচ্ছিল। তবে আন্দোলনে অংশ নেওয়া অনেক শিক্ষার্থী তাদের এ ঘোষণা মেনে নেননি।

গতকাল ফরিদপুরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন আরমান শিকদার নামে এক শিক্ষার্থী। ফরিদপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ষষ্ঠ সেমিস্টারের এই শিক্ষার্থী নিজেকে ফরিদপুরে কোটাবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক বলে দাবি করেন।

‘সাধারণ শিক্ষার্থী মঞ্চ’ কারা জানে না বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন : সারা দেশে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার দাবি করা ‘সাধারণ শিক্ষার্থী মঞ্চ’ নামে সৃষ্ট নতুন প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোনো সম্পর্ক নেই বলে জানিয়েছেন কোটা সংস্কার আন্দোলনের একজন সমন্বয়ক। ‘সাধারণ শিক্ষার্থী মঞ্চ’ প্ল্যাটফর্মটির সমন্বয়ক হিসেবে এলিয়ান কাফী প্রতীক নামে একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর নাম রয়েছে। তিনিসহ ৯১ জন সাধারণ শিক্ষার্থীর সই করা একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে পাঠানো হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে এলিয়ান কাফী প্রতীকের মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি ফোন ধরেননি।

এদিকে এই ‘সাধারণ শিক্ষার্থী মঞ্চ’ কারা—তা জানে না কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। জানতে চাইলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আব্দুল কাদের কালবেলাকে বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে শিক্ষার্থী মঞ্চ নামক কোনো সংগঠনের কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা নেই। আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করার জন্য অনেকে নানা ধরনের প্ল্যাটফর্ম খোলে। এটাও সেরকম হতে পারে।’

৬ সমন্বয়কের আন্দোলন প্রত্যাহার ও তার স্বাক্ষরে ফের কর্মসূচি ঘোষণার বিষয়ে জানতে চাইলে আব্দুল কাদের বলেন, ছয় সমন্বয়ককে দিয়ে জোর করে বিবৃতি দেওয়ানো হয়েছে। ছাত্রসমাজ এটাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা কর্মসূচি ঘোষণা করেছি।’

তিনি বলেন, ‘সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতামত ও চাহিদার ভিত্তিতে আমাদের দেওয়া নয় দফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব। বাইরে আমরা যে সমন্বয়করা আছি নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করেই কর্মসূচি দিয়েছি। আমাদের মধ্যে কোনো বিভাজন নেই।’

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন প্রত্যাহারের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যেসব প্রতিষ্ঠানে কর্মসূচি প্রত্যাহার করা হয়েছে, সেখানে সমন্বয়কদের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। অনেকেই চাপের মুখে এমন ঘোষণা দিচ্ছেন বলে আমাদের জানিয়েছেন।’

 

-কালবেলা

সর্বাধিক পঠিত


ভিডিও